"জীবনের প্রথম কান্নাটা কিন্তু আমাদের মানুষের মতই ছিল,বিড়ালের মত না"-অপর্না ব্যানার্জী
একদম অন্যরকম কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলতে সেদিন আমরা পৌছে গিয়েছিলাম অপর্না ব্যানার্জীর কাছে। উনি নিজের কাজের সূত্রে এদেশে তো বটেই,বিদেশেও যথেষ্ট পরিচিত ব্যক্তিত্ব। উনি AMITIE Trust নামে একটি স্বেছাসেবী সংস্থা চালান।এই NGO টি আইনতভাব কাজ করে "Human rights" এর উপর ।LGBT (lesbian gay bisexual transgender) community কে কেন্দ্র করেই তাদের কাজের পরিধি বিস্তৃত। অথচ এত ভালো কাজ করেও আজ উনি বা ওনারা সমাজের মধ্যে থেকেও প্রান্তিক। শুধুমাত্র তাদের যৌনসত্তা দিয়েই তাদের পরিচয় বিচার করেছে সমাজ। একবারও ভেবে দেখা হয়না যে এরাও কিন্তু আমাদের মতোই একজন মানুষ। তবুও মানুষের মৌলিক অধিকারটুকুও পাননা ওনারা। তাদেরই কিছু কথা আমরা তুলে ধরলাম আপনাদের কাছে।
১) প্রথমেই আপনার ব্যাপারে কিছু জানতে চাই।কবে থেকে আপনার মনে হল যে আপনি একটু অন্যরকম? উঃ- আমি একজন পুরুষ হয়েই জন্মেছিলাম, নিজেকে নারী ভাবতাম। নারী ভাবতে ভাবতে একদিন মনে হল, গোটা দেশটাই কেমন অন্যরকম। তখন নিজেকে নারী ভাবতেও ইচ্ছে করলনা। কেমন একটা হয়ে গেলাম। নিজের পোশাক বদলে গেল। আস্তে আস্তে বুঝলাম, আমি পুরুষ ও নই,নারীও নই; আবার তথাকথিত "হিজরে"ও নই। ওটা তো আমার পেশা। ২) তাহলে আপনার ঠিক কাকে ভালোলাগে, পুরুষকে নাকি নারীকে? উঃ- আমার কাকে ভালো লাগে, বা আমি কার সাথে শুই, সেটা আমি সমাজকে বলব কেন? তোমরা ঘরে ঢোকার সাথে সাথে কি আমি জিঞ্জাসা করেছি, তোমরা gay বা lesbian কিনা। কিন্তু সমাজের আমাদের প্রতি প্রথম জিঞ্জাসাই এটা থাকে যে, আমরা কার সাথে শুই। আমার ভালো লাগে এখন কোন মহিলার সাথে শুতে। আমার যেটা ভালো লাগে, সেটা আমি করবই। ৩) সাধারন সমাজ থেকে তো আপনারা আলাদা থাকেন, এটা কেন? উঃ- আলাদা আমরা থাকিনা, ছোটবেলা থেকেই আমাদের আলাদা করে দেওয়া হয়। আমরা শুধু অবহেলিত হই। আস্তে আস্তে নিজেরাই সরে আসি, বারবার মনে হয়, ওখানে গেলেতো আবার আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করবে, বিদ্রুপ করবে, তাই আমরা সর্বসমক্ষে যাই না। সমাজ আসলে ছেলে আর মেয়েদের জন্য কিছু নির্দিষ্ট ছক কেটে দিয়েছে। যেমন একটি মেয়ে কাঁদলে অনেক সহানুভূতি পায়, কিন্তু একটি ছেলে নাকি কাঁদতেই পারে না। এটা কেন? ছেলেদের কি মা মারা গেলেও কাঁদতে নেই? আর যদি কোন পুরুষ নরম হয়,তাহলে তাতে দোষ কোথায়? একজন মহিলা শক্ত হতে পারে, আর একজন পুরুষ নরম হতে পারে না? ৪) আচ্ছা এখানে যারা যারা আছেন, সবাইকেই কি বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে? উঃ- একেবারেই না।আমরা কেউ নিজেদের বাড়ি ছেড়ে চলে আসিনি। আমরা যেটা ছেড়েছি, সেটা আমাদের বাপের বাড়ি। আর এখন যেখানে আছি, সেটা আমাদের নিজ়ের বাড়ি। ৫) আপনাদের ব্যাপারে মানুষের ধারনাটা ঠিক পরিষ্কার না, সেটাকে আপনারাই স্পষ্ট করে দেননা কেন? উঃ- আসলে এর মধ্যে অনেক political issue আছে সেগুলিকে আমরা clear করে দিতে চাইনা। তাহলে আমাদের জীবিকায় সমস্যা হবে। ৬) আপনি এরকম হলেন কেন? তার জন্য কি কেউ কোনভাবে দায়ী? উঃ- একটি ৭-৮ বছরের শিশু যদি একটি পুরুষমানুষের দ্বারা raped হয় তাহলে তার মনের অবস্থা কি হতে পারে সেটা তোমরা কল্পনা করতে পার? তার দোষ ছিল যে, সে মেয়েলি। ৭ বছরের বয়সে আমার মামা আমায় molest করে।আমায় বলা হয় হাতিবগানের মার্কেট এ নাকি বাচ্চা বিক্রি হয়, সেখান থেকে আমায় কিনে আনা হয়েছে। আমাকে বাধ্য করা হয়েছে নিজেকে মেয়ে ভাবতে।আমার মধ্যে যে মেয়েলি সত্ত্বা ছিল, তাকে যদি ওই বয়সে molest করা হয় ঝড় তো উঠবেই।বূঝলাম নিজেকে।হয়ত এভাবেই বোঝার ছিল আমি কে। ৭) পুলিশ এই ব্যপারে কোন পদক্ষেপ নেয়নি? উঃ- পুলিশে case করতে গেলে বলল, একটি ছেলে একটি ছেলেকে rape করতে পারেনা। আমি যখন দ্বিতীয়বার raped হই park circus ময়দান এ, তখন চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে চিকিৎসা করতে গেলে তারা বলে, একটি ছেলে একটি ছেলেকে কখনই rape করতে পারেনা। কিন্তু আমরাই যখন সেজেগুজে রাস্তায় রাত ২টোয় দাঁড়িয়ে থাকি, তখন অনেক গাড়ি আমাদের দেখে দাড়িয়ে যায়। |
৮)কিন্তু ৩৭৭ ধারা তো এখন আইনত বৈধ, তারপরেও কিছু হয়নি ?
উঃ- Decriminalized হওয়ার পর কিন্তু আমাদের ওপর হেনস্থা হওয়া আরও বেড়ে গেছে। আরও বেশি মার খেয়েছি আমরা। ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে করলে ক্ষতি নেই। সর্বসমক্ষে করলেই সমস্যা। আমাদের প্রত্যেকের সেই অভিঞ্জতা আছে। আমাদের যে একটা sexual life আছে এটা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। হিজরেরা হচ্ছে সতী, আমায় অনেকে জিঞ্জাসা করে, "আচ্ছা তোমরা মেলামেশা কর?" আমি উত্তর দিই,"খুব করি, মেলামেশা ছাড়া আমার ভালোই লাগেনা।" আরে মেলামেশা করবনা কেন? আমরাও তো মানুষ। ৯) আপনি নিজেকে ঠিক কেমনভাবে দেখতে পছন্দ করেন? উঃ- আমি "no gender person"। আমার কোন gender নেই। আমি পুরুষের মত প্রতিবাদ করতে জানি। শক্ত হয়ে দাড়াতে পারি, মেয়েদের মত চোখে চোখে কথা বলিনা আমি। আমি শাড়ি পড়ি কারন আমার শাড়ি পড়তে ভালোলাগে। আমি নিজেকে নারী ভাবতে পারিনা। ১০) কিছু লোক ভাবে,আপনারা এমন কিছু করেন যেটা ঠিক মেনে নেওয়া যায় না, আপনাদের কিছু কাজ তাদের অসভ্যতা বলে মনে হয়। এরকম করার কারন কি? উঃ- বেশ করি। ঢাকুরিয়ায় একটি বাচ্চাকে তার মা দোকানে পাঠিয়েছিল কিছু জিনিস আনতে, তখন কিছু মধ্যবয়সী ছেলে তার পেছনে কাঠি ঢুকিয়ে দিয়েছিল ঠিক এই কারনে যে, কেমনলাগে তারা দেখবে। আমাদের অসভ্যতা এই অসভ্যতার থেকে অনেক কম। ১১) আপনারা কি তাহলে এরকম ব্যাবহার করেন আত্মরক্ষার জন্য? উঃ- একেবারেই না।আমরা শুধু দেখাতে চাই আমরা তোমাদের থেকে বেশি শক্তিশালী। আমরা তোমাদের থেকে সবকিছু আদায় করতে পারি। আর আমরা যে টাকাটা নিই, সেই টাকাটা তোমরাই আমাদের রোজগার করতে দাওনি। কোন অফিসে আমাদের চাকরি দেওয়া হয়না। আমরা এত শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও চাকরি পাই না। আর পেলেও best performer হওয়ার পরও আমাদের বের করে দেওয়া হয়। সত্যি ভাবতে অবাক লাগে, আমরা কিন্তু শুধুমাত্র sexuality দিয়ে বিচার করেই অপর্নাদিদের সমাজ থেকে আলাদা করে দিই। ওনারা সামনে আসলে , আমরা হয় ভয় পাই, নাহলে হাসাহাসি করি। একবারও ভেবে দেখি না ওনারাও কিন্তু মানুষ। জীবনের প্রথম কান্নাটা ওনারা মানুষের মতনই কেঁদেছিলেন। অপর্নাদি কিন্তু এক অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত মানুষ। তথাকথিত "common man" দের থেকে উনি অনেক এগিয়ে। শুধু অপর্নাদিই নন, ওনাদের মত অনেক অনেক মানুষই আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। অথচ তারজন্য নূ্নতম সন্মানটুকু আমরা তাদের দিইনা। তারা খারাপ ব্যাবহার করে আমাদের থেকে টাকাটা যে নেন, সেটা আমরা মনে রাখি। কিন্তু সেই টাকাটা দিয়েই তারা যখন কোনো অনাহারক্লিষ্ট শিশুকে দুধ কিনে দেন, সেই উপকারটা আমরা বোধহয় খেয়াল করিনা। "Amitie Trust" এর বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ডিসেম্বরে। এ্কটি নাটক অনুষ্ঠিত হবে। নাম "একলব্য"। ওনাদের একজনের জীবনের কাহিনী অবলম্বনে। "Whatzup Kolkata" র পক্ষ থেকে আপনাদের কাছে বিনীত আবেদন, দয়া করে অনুষ্ঠানটি দেখে আসুন। আমরা নিশ্চিত, আপনারা মাথা নিচু করে বাড়ি যাবেন এটা ভাবতে ভাবতে যে, এতদিন যাদের আলাদা করে রেখেছি আমরা, তারা আমাদের থেকে কতটা এগিয়ে! আর তারপর কোনোদিন সামনে কোন "হিজরা" দেখলে আপনি একবার হলেও ভাববেন যে,যাকে নিয়ে হাসছি, সে আমার থেকে অনেক অনেক বেশি শিক্ষিত, প্রতিভাশালী। লড়াইয়ে আমরা ওনাদের পাশে সবসময় আছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, আজ না হলেও কাল ওনারা প্রাপ্য সন্মানটা পাবেনই। Receive all updates via Facebook. Just Click the Like Button Below? You Can also Receive Free Email Updates:Powered By NBT |